জলতরঙ্গের ক্যানভাস

জলতরঙ্গ হাসান ইনামের দ্বিতীয় উপন্যাস। যা প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ বইমেলায়। মেলার দ্বিতীয় দিনে প্রকাশিত হওয়া এই বইটি নিয়ে চলছে হৈ-হুল্লোড়। পাঠকের দিনগুলোও জলতরঙ্গের সাথে কাটছে দারুনভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে অধ্যয়নরত এই লেখক, তার জাদুকরী কৌশল দেখিয়েছে জলতরঙ্গে। সেক্ষেত্রে তার অধ্যয়নরত বিষয়টি তাকে সাহায্য কতোটুকু করেছে জানিনা, তবে তার মনে গল্পটা যতটুকু জায়গা জুড়ে ছিলেন পুরোটাই তিনি ঢেলে দিয়েছেন বইয়ের ভেতরে। প্রতিটা প্যারায়, প্রতিটা অধ্যায়ে তিনি দক্ষতার ছাপ দেখিয়ে গিয়েছেন। শিরোনাম দেখে ইতোমধ্যে আপনাদের বুঝে যাওয়ার কথা আমি জলতরঙ্গ নিয়ে কি আলোচনা করতে যাচ্ছি সামনে। তবুও আপনাদের সুবিদার্থে আরও একবার বলেই দেই আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে জলতরঙ্গের ক্যানভাস বা চিত্রপট!

১০০ অধ্যায়ের এই উপন্যাসটি শুরু হয়েছে কিছু চিত্রপট দিয়ে। আসলে ‘কিছু’ বললে ভুল বলা হবে, বরং বলা ভালো ‘বহু চিত্রপট’ দিয়ে। সেটার ভেতরে আমাদের প্রাণের, কিন্তু জ্যামের ফাঁদে পড়ে বিরক্ত হয়ে গালি দেয়া শহর ‘ঢাকা’ তো রয়েছেই, এছাড়াও রয়েছে কুয়েতসহ আরও অনেক স্থানের খন্ডচিত্র। স্থান বিষয়ের আলোচনায় আমরা যাবোনা, তবে বহু স্থান যে রয়েছে সেটা তো জেনেই গিয়েছেন। শুরু থেকে বেশ কয়েকটা অধ্যায়েই এরকম অর্ধেক চিত্র রেখে গিয়েছেন লেখক। মনে হয়েছে, যেনো নিজের প্রবল শিল্পের দক্ষতা এবং ক্ষমতার গুনে সুতো বুনছেন গল্পে। এই সুতো বুনতে গিয়েছে বহু মানুষের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছেন লেখক। যেভাবে তিনি শুরুর দিকে ১৭৯৯, ১৮০০ ইত্যাদি সালগুলোর বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন সেটাতে বুঝতে আর পাঠকের বাকি থাকবেনা, যে কিভাবে টুকরো টুকরো জায়গাগুলোকে তিনি সুক্ষভাবে দেখাতে চেয়েছেন। এরপরে, পরিচয় করালেন তোপকাপি প্রসাদ, উত্তাল পারস্য উপসাগর, ঢাকার কেন্দ্রিয় কারাগার, মৌরিতানিয়া আরও অনেক কিছুর সাথেই। পাঠকের বোঝার স্বার্থে প্রথম কিছু অধ্যায়ে এসব জায়গার গল্প বলে যাওয়ার পাশাপাশি, তা হজম করার সময়ও দিয়েছেন তিনি। কয়েকটা প্রেক্ষাপট,কিছু গল্প এবং সেটা কন্টিনিউ করে গিয়ে পাঠককে আটকে রেখেছেন তার আঁকা ক্যানভাসে। এরপরে আবারও খন্ডচিত্র, আবারও সেই পরিচিত কয়েকটা চিত্রে কিছুক্ষণ গল্প বলে যাওয়া, সবই করেছেন দক্ষতার সাথে। তবে সবকিছুর পরেও সবচেয়ে আগ্রহ জাগানিয়া বিষয় ছিলো, এতোগুলো প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি সুতো বুনতে শুরু করেছেন ঠিকই, তবে সবকিছু কি এক জায়গাতেই ঠেকাতে পারবেন তিনি? প্রশ্নটার উত্তর খুবই সহজ, আশা করি এই উত্তরটাও আপনারা এতোক্ষণের আলোচনার কিছু লাইন পড়ে বুঝে গিয়েছেন।

এতোগুলো প্রেক্ষাপটকে একস্থানে মেলানোটা একটা দক্ষযজ্ঞের মতো কাজ, সেটা দৃশ্যমান ছিলো গল্পে। চিত্রপটে এতো জায়গা ছিলো, যে নাকানিচুবানি খাওয়াবেন লেখক আপনাকে। তবে সেটা অবশ্যই ভালো অর্থে। পাঠককে বোকা বানানোর মতো কিছুই করেননি তিনি। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে করে গিয়েছেন, বলে গিয়েছেন একটা দারুন গল্প। ‘কে’, ‘কি’, ‘কিভাবে’, কেনো’ ইত্যাদি প্রেক্ষাপটগুলোই কিন্তু আসলে এই গল্পের ক্যানভাস বা চিত্রপট। তবে এই প্রেক্ষাপটগুলো সব উপন্যাসেই কমবেশি থাকে। তবে জলতরঙ্গের সবচেয়ে স্ট্রং পার্ট ছিলো গল্পের প্রতি জাস্টিফাই করার জন্য লেখকের দারুন উত্তর। সব উপন্যাসে এরকম প্রশ্ন থাকলেই যে আপনি দারুনভাবে উত্তর পাবেন, ব্যাপারটা একদমই সেরকম নয়। এখানেই লেখকের লেখার স্বার্থকতা। ভালো একটা গল্প বলা মোটেও সহজ কাজ নয়, তাও এতোগুলো প্রেক্ষাপট নিয়ে। যদি ধরেও নেই যে বিষয়টা সহজ, তাহলেও গল্পের শেষে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলা কিংবা শেষটাকে দারুন না করতে পারাটা আরেকটা ব্যর্থতা। তবে উভয় ক্ষেত্রেই লেখক পুরোপুরি সফল।

যাই হোক, ক্যানভাস দিয়ে বলতে বলতে এইযে অন্যদিকেও ঘুরে এলাম আমরা, ঠিক এমন করেই লেখকও আপনাকে একটা গল্প বলতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে যাচ্ছে। লিখতে লিখতে একটা জিনিস মাথায় এলো। সেটা না বললে, লেখকের চিত্রপটের বিষয়টা আসলে অব্যক্তই থেকে যায়। ধরুন, জলতরঙ্গ হচ্ছে একটা আর্ট পেপার। যেখানে আছে মানুষ, পাখি, ঘড়, গাছ-পালা, পুকুর আরও বহু কিছু। আর লেখক সেই জিনিসগুলোই এঁকে গিয়েছেন দক্ষ শিল্পির মতো। মানুষ নিয়ে কথা বলার পরে তিনি সরাসরি চলে গেলেন আকাশে, পাখি নিয়ে কথা বলতে। এরপরে দেখা গেলো, সেই পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে চিত্রপটের পুকুরটার উপর দিয়ে। সাথে সাথেই লেখক শুরু করলেন সেই পুকুরটার বর্ণনা। উপরে যা বললাম, সেটা শুধুমাত্র লেখকের দক্ষতা বোঝাতে। এভাবেই সবকিছু একটার সাথে আরেকটার মিলবন্ধন রেখে গল্প বলে গিয়েছেন লেখক। একটা ক্যানভাসেরই বহুদিক এভাবেই ফুটে উঠেছে তার লেখায়।

আলোচনা যেহেতু শুধুমাত্র গল্পের ক্যানভাসটা নিয়ে তাই সেটা নিয়েই কথা বলে গেলাম। গল্পটা তো নি:সন্দেহে দারুন, তবে যেহেতু বিশাল ক্যানভাসে লেখা, সেটা নিয়ে বলতে গেলে আলোচনা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। স্পয়লারহীন বক্তব্য রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছি আলোচনার শুরু থেকে একদম শেষ পর্যন্ত। আমার এই আলোচনার উদ্দেশ্যই ছিলো লেখকের বিশাল ক্যানভাসে গল্পটা বলার ভঙ্গিমা সম্পর্কে কিছু বলা, আশা করি সেটা আমি এতোক্ষণে কিছুটা হলেও আপনাদেরকে বোঝাতে পেরেছি। আমার এই লেখাটা পড়ে তেমন কিছু জানতে বা বুঝতে পারবেন না বলে দু:খিত। এতোটুকু আমি বলতে পারি, যে গল্পটা শেষ হওয়ার পরপরই আপনি বুঝে যাবেন যে কেনো জলতরঙ্গের ক্যানভাসটা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হলো। গল্পটার পড়ার পরপরই মনে হয়েছে এটা নিয়ে কথা বলা যায়। প্লট নিয়ে কথা অনেকেই বলে যাবে সামনের দিনগুলোতে, তবে লেখকের বোনা এই বিশাল ক্যানভাসটা অবশ্যই দারুন একটা আলোচনার যোগ্য। গল্পটার গভীরতা বোঝাতে গিয়ে অনেক বিষয়ে কিছু অতিরিক্ত বক্তব্য ছিলো বলে দু:খিত, তবে গল্পটা পড়ার পরে এই বক্তব্যগুলোর অর্থ খুঁজে পাবেন বলেই আশাবাদী। আলোচনাটা দারুন হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা আমার নেই। তবে মুগ্ধ আপনাকে হতেই হবে জলতরঙ্গের ক্যানভাসে।

জলতরঙ্গের ক্যানভাস
-সিয়াম মেহরাফ

শেয়ার করুনFacebookTwitterWhatsApp
লিখেছেন
সিয়াম মেহরাফ
আলোচনায় যোগ দিন

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ একজন লেখক এবং গল্পকথক। তার বর্তমান মৌলিক বইয়ের সংখ্যা দুইটি। লেখালিখির পাশাপাশি অভিনয়ও তার আরেকটি প্যাশন।

নোটঃ

এই ওয়েবসাইটটির সকল ছবি, লেখা এবং ভিডিও সিয়াম মেহরাফ দ্বারা সংরক্ষিত। ওয়েবসাইটটির কোনো তথ্য ক্রেডিট কিংবা কার্টেসি ছাড়া কপি না করার অনুরোধ রইলো।

error: