বসন্ত এসেছিলো সেদিন

সাল ১৯৭২

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে বেশিদিন হয়নি। দেশের মানুষ তখন নৃশংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ কাটিয়ে উঠছে কেবল। তখনো সূর্য এখনকার মতো প্রবল তাপ ছড়ালেও, কেমন একটা গম্ভীর ভাব রয়ে গেছে চারদিকে। কারো কারো মুখে যেমন দেশ স্বাধীনের হাসি, আবার কারো কারো মুখে প্রিয়জন হারানোর শোক। কত মানুষের আপনজন যে চলে গিয়েছে বর্ডার পার হয়ে ভারতে, তা গুনে শেষ করাটা কষ্টকর।

ধু ধু মরিচিকার মতো এদিক থেকে ওদিক তাকালেই দেখা যায় পুড়ে যাওয়া কালো বাড়ি। থমকে যাওয়া সময়। রক্তের গন্ধে ভেসে থাকা চারপাশ। আমি তখন আমার পরিবার নিয়ে বেশ সুখেই ছিলাম। কারো কোনো ক্ষতি হয়নি, সবাই সুস্থ। এই সুস্থতা আর বেঁচে থাকাটা তখন নৃশংসতার কাছে যে কতোটা কঠিন ছিলো, সেটা কেবল তারাই জানে যারা সময়টা দেখেছে।

হুট করেই চারদিকে আবার কেমন ভয় শুরু হয়ে গেলো মানুষের মধ্যে। মারা যেতে থাকলো একের পর এক মানুষ। অজান্তেই, কোন কারণ ছাড়াই শুন্য হয়ে যেতে থাকলো একটা পাড়া থেকে শুরু করে একটা মহল। পাকিস্তানিরা কি বীজ শরীরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে তা ভাবতে ভাবতেই ঘাবড়ে যেতে লাগলো তখন বহু মানুষ।

একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে যেতে থাকলো এই মহামারী। মহামারী বলছি কারণ, যেই পাড়াতেই কারণ ছাড়াই কেউ মারা যেতো সেই পারা পুরোই ধূলিসাৎ হয়ে যেতো, মাত্র কিছুদিনের ভেতরেই।

আমাদের এলাকায় একজন গন্য মান্য ব্যক্তি থাকতেন। তার ওই সময়টাতে প্রবল রকমের ক্ষমতা ছিলো। বিশাল পরিমাণ জায়গা জমির মালিক সে। একদম জমিদারি জীবন-যাপন। তার সেই জমিদারি অক্ষত রয়েছিলো দীর্ঘ বহুমাস যুদ্ধের পরেও। হঠাৎ করেই সেই জমিদার অসুস্থ হয়ে পড়লো একদিন। দূর-দূরান্ত থেকে ডাক্তার ডেকে আনা হতো তার চিকিৎসার জন্য। বহু লোক জান-প্রাণ দিয়ে ওনাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো সেই সময়ে।

একদিন শুনেছিলাম ঢাকা থেকে বড় ডাক্তার আনিয়েছে তার বাড়ির লোকজন। এলাকা ছোট ছিলো বলে সব কথাই খুব দ্রুত ছড়াতো। তার শরীরেও সেই একই রোগ পাওয়া গিয়েছিলো নাকি তখন। ডাক্তার দেখতে এসে নিজেই ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। এলাকার রাস্তা জুড়ে লোকজন পাহারা দিতো, পুরো গলি আর তার বাড়িতে ঢোকার রাস্তা। আমাদের এই এলাকার রাস্তাটা ধরেই বাজার ঘাটে যেতে হতো।

সেদিন সন্ধ্যায় বাজারের কাজে আমাকে বাইরে যেতে হয়েছিলো। সেদিন নিজের বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বের হতেই দেখি রাজার পাহারাদার লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। গলির মাথা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একজন বন্ধুক নিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমি তাকে চিনি! জমিদারের বাড়িতেই কাজ করে সে। আমাকে দেখে সেও চিনতে পারলো। আমাকে বেরোতে দিলো সে। তখনো সত্যি বলতে আমি বুঝতে পারছিলাম না, কি হচ্ছে এগুলো কিংবা কেনো হচ্ছে। তবে সেদিনের গলি থেকে বের হয়ে যাওয়াটাই যে আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, সেটা তখনো বুঝিনি আমি।

বাজার শেষে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম আমি। গলির মাথায় এসেই বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হয়েছে এদিকে। কেমন একটা গমগমে পরিবেশ ছিলো। গলিটার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল জমিদারের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। বিষয়টা খুব একটা সুবিধার মনে হয়নি আমার। আমি গলিতে ঢোকার সাহস পেলাম না।

কিছুক্ষন বাদেই জমিদারের আরেকজন লোক এসে দাঁড়ালো আমার হাতের বা পাশে। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো, আমিও হাসলাম। এই লোকটাকেও চিনি আমি। ভীষণ ফর্সা আর খাটো মতো লোকটা আমার পাশেই দাঁড়িয়েই আছে। দেখলে মনেই হয়না এর জন্ম পাহারাদার কিংবা জমিদারের চাকর হওয়ার জন্য হয়েছে। উলটো তাকে দেখলে মনে হয় জমিদার পুত্র।

আমি তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে, ডান দিকে একটু ফিরলাম। মূহুর্তের মধ্যেই সে আমার বা’হাতের মধ্যে কি যেনো একটা করলো। আমি টের পেলাম হাতের ওই অংশটা পুড়ে যাচ্ছে আমার। আমি তার দিকে না তাকিয়ে আমার হাতের দিকে তাকালাম। গোল একটা কালো দাগ হয়ে রইলো সেখানে, অল্প অল্প ধোঁয়াও উড়ছে যেনো! শরীরে একটা অদ্ভুত অনূভুতি হলো আমার। তার দিকে তাকাতেই সে একটা বাক্য বললো আমায়। আবারও আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলো সে সাথে সাথেই।

আমি অন্য বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে আমার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম সেদিন। সফলও হয়েছিলাম। তার কিছুক্ষণ বাদেই শুনি সেই জমিদার আর বেঁচে নেই। ওই গুরুতর রোগেই সে প্রাণ হারিয়েছে তার। কিছুদিন বাদে জমিদারে স্ত্রী, এবং একে একে তার বাড়িতে কাজ করতে থাকা লোকগুলোও!

সেদিন ওই চাকরের বলা বাক্যটা আজও আমার কানে বাজে। “জমিদারের বসন্ত হইছে।” কথাটা আমি বুঝতে পারিনি সেদিন। পরে বুঝেছিলাম, ওটাই ছিলো সেই রোগের নাম। ওই চাকর আমার হাতের সাথে কি করেছিলো, তা আমি সঠিক জানিনা। হয়তো কোনো প্রতিরোধক কিছুই ছিলো সেটা। আমার পরিবারের অনেকেই ওই রোগে পরবর্তী সময়ে মরে গেলেও, আমি বেঁচে আছি এখনো। অনেকদিন। হয়তো সেই কালো দাগই বাঁচিয়েছিলো আমায়! কিন্তু সেই পাহারাদারকে আর খুঁজে পাইনি আমি। জানিওনা সে আমার হাতেই কেনো সেই প্রতিরোধক দিয়ে দিয়েছিলো। আজও এই কথার উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত। জানি কখনোই হয়তো পাবোনা উত্তরটা।

রোগের নাম এবং পরিনতি জানতে পারার পরে এটাকে তখন “মহামারী রোগ” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। বেঁচে থাকাটা অসম্ভব ছিলো এই মহামারী শরীরে একবার ঢুকলে। ১৯৭৯ সালের দিকে এই রোগ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া শুরু করে। অল্প-সল্প থাকলেও, তখন সেটা সারিয়ে ফেলাটা সম্ভব ছিলো। কিন্তু ওই দিনগুলোর কথা মনে করলে আজও বুকটা কেঁপে উঠে আমার। এখনো কিভাবে বেঁচে আছি আমি জানিনা। কিন্তু আসলেও, “বসন্ত এসেছিলো সেদিন”

শেয়ার করুনFacebookTwitterWhatsApp
লিখেছেন
সিয়াম মেহরাফ
আলোচনায় যোগ দিন

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ একজন লেখক এবং গল্পকথক। তার বর্তমান মৌলিক বইয়ের সংখ্যা দুইটি। লেখালিখির পাশাপাশি অভিনয়ও তার আরেকটি প্যাশন।

নোটঃ

এই ওয়েবসাইটটির সকল ছবি, লেখা এবং ভিডিও সিয়াম মেহরাফ দ্বারা সংরক্ষিত। ওয়েবসাইটটির কোনো তথ্য ক্রেডিট কিংবা কার্টেসি ছাড়া কপি না করার অনুরোধ রইলো।

error: