শব্দ ছাড়াও বিদায় দেয়া যায়!
শেয়ার করুনFacebookTwitterWhatsApp

শব্দ ছাড়াও বিদায় দেয়া যায়!

শুরুতেই এমন হওয়ার তো কথা ছিলোনা! চুপচাপ থাকার কথাটুকু তো ছিলো আমার, অথচ চুপচাপ থেকে গেলো সে। প্রথম দেখায় তার আমাকে কতোকিছু মন খুলে বলে দেয়ার কথা ছিলো, কিন্তু সে বলেনি কিছুই। অবাক করা ব্যাপার! বেশ সেজেগুজে তার কাছে প্রথমবার ঘেষতে চেয়েছিলাম আমি। তবুও কেমন একটা অবাক করা বিষয়, বিন্দুমাত্রও চিন্তা না করেই ঘরোয়া পোষাকেই বের হয়ে গিয়েছিলাম! এতোকিছু যদিও খেয়াল ছিলোনা আমার, ছিলো শুধু সামনাসামনি সে দেখতে কি অনেক সুন্দর এতোটুকু দেখাই! দেখতে পেয়েছিলাম। আসলেও সুন্দর, ভীষণ সুন্দর। মায়া ভরা চেহারা তার। টান টান করা চোখও আছে দুটো। যদিও এবারেও দূরত্ব ছিলো। মাটি থেকে বিশাল দূরত্বের ছাদের দূরত্ব। তবুও আমি তার চেহারাটাকে পড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম বৃথা। বুঝতে ব্যর্থ হলাম, সে কি প্রথম দেখায় সেই প্রথম কথা বলার সময়টার মতো টান ধরে রাখতে পেরেছে? নাকি পারেনি? ওই ছাদ আর মাটির দূরত্বটুকু, পৃথিবী আর চাঁদের দূরত্বের সমান মনে হচ্ছিলো আমার তখন। কিন্তু তবুও এই দূরত্বটুকু পেরিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার সাহসটা আমার ঠিক ছিলোনা। তাকে পড়ার চেষ্টাতেও বৃথা হলাম ভীষণভাবে। আশেপাশে এতো মানুষের আনাগোনা আর সহ্য হচ্ছিলোনা আমার। বিরক্ত হচ্ছিলাম কেনো যাচ্ছেনা, কেনো না! যাচ্ছিলোনা কেউই। বরং, আরও বাড়ছিলো। কি সাংঘাতিক নিয়তি আমার! ফিরে এলাম বাসায়। আর কিছুক্ষন পরে খুব কাছ থেকে তাকে দেখতে পাবো। একদম খুব কাছ থেকে। কিন্তু তার কেমন এক উদ্ভট ইচ্ছা হলো আমাকে আবারও দেখার। তার বায়না ফেলার মতো ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে কখনোই দেয়নি, চাইওনা দিক। সেদিনও ছিলোনা। চলে গিয়েছি তাকে দেখা দিতে। আবারও দেখলো সে আমাকে। এবার হয়তো দু-একবার আমিও তাকে। আবারও লোকসমাগম!  চলে আসতে হলো!

আর মাত্র দুই-এক ঘন্টা। এরপরেই দেখা হবে তার সাথে আমার। ঘুমালাম, কিন্তু ঘুম ঠিকঠাক হলোনা! যেতে হলো তার কাছে আবারও। ছাদ আর মাটির দূরত্বে বসে সে বেশ হাসছিলো। অথচ সামনাসামনি সে কেমন এক নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে! মনে হচ্ছে, আমার সামনে একটা মানুষ বসে আছে যে আমাকে চেনে না! নিরবতাটুকু শেষমেষ আমাকেই ভাঙ্গতে হলো। হ্যা, শুরুতে এমন হওয়ার তো কথা ছিলোনা! চুপচাপ থাকার কথাটুকু তো ছিলো আমার, অথচ চুপচাপ থেকে গেলো সে। প্রথম দেখায় তার আমাকে কতোকিছু মন খুলে বলে দেয়ার কথা ছিলো, কিন্তু সে বলেনি কিছুই। অবাক করা ব্যাপার!!

সে হাসলো অনেক, হয়তো কিছুক্ষন মন খারাপও করে ছিলো আমার চোখের অজান্তে। কিন্তু তার ইচ্ছেগুলোকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্ধকারে তাকে একবার বুকে জড়িয়ে নিতে ভুল করিনি একদমই আমি। নিরবতাটুকু ভেঙ্গেছিলাম আমি, লাজুকলতাটুকুও তাই ভেঙ্গেছিলাম। তার শরীরের তাপ নিয়েছিলাম তাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিলো সেসব! মাত্র কয়েক সেকেন্ড!

এরপরে চা-খাওয়া, কিছু ছবি আর তার বিদায়! রিকশায় উঠে চলে যাওয়ার সময় সে আমার দিকে তাকিয়েছিলো কিনা জানিনা! তবে আমি ছিলাম। রিকশাটা চলে যাচ্ছিলো, আর সে তার গন্তব্যে। জানি আবারও আমার তার সাথে দেখা হবে! এইতো তার পরেরদিনই! কিন্তু কি এক বিষন্নতা ভর করেছিলো মনে কে জানে! মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি তাকে আর দেখতে পাবোনা। সেই দেখতে পাবোনার ধারণাটুকু কি যে যন্ত্রণা দিচ্ছিলো তখন! এই যন্ত্রণা নিতে না পেরেই বোধহয় যতক্ষন না চোখের আড়াল হচ্ছিলো তার রিকশা, আমি তাকিয়েই ছিলাম।

সেদিনই তার সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিলো। পরেরদিন দেখা করার কথা থাকলেও সেদিনই আবার হয়েছিলো। সম্ভবত, সৃষ্টিকর্তাই চেয়েছিলেন, অথবা সৃষ্টিকর্তা দিয়েছিলেন! তার ইচ্ছায় হয়তো সে আমাকে দেখতে চেয়েছিলো, আর আমার ইচ্ছায় তাকে! প্রার্থনায় মিল থাকলে নাকি সৃষ্টিকর্তা ফেরায় না! সেটাই হয়তো হয়েছিলো সেদিন! হয়তো না, আসলেও হয়েছিলো। ওইদিনের কথাগুলো, ওই মুহূর্তগুলো একান্তই আমাদের ছিল, একান্তই আমাদের তাই এড়িয়েই গেলাম সেসব!! তবে বুঝেছিলাম সেদিন ভালোবাসি কতোটা, ভালোবাসা কতোটা!

পরেরদিন, তার সাথে আমার আবার দেখা। রিকশায় করে তার সাথে একটু এদিক-ওদিক যাওয়া! কথা বলেছিলাম সেদিন অনেক আমরা। কিন্তু মনের এক কোণে একটা ঘড়ি টিকটিক করে বলে দিচ্ছিলো, আর কিছুক্ষন পরেই সে চলে যাবে। হারিয়ে যাবে সব। সেই টিকটিক শব্দ করে চলা ঘড়িটায় ৬০ সেকেন্ডে ১ মিনিট হলেও, মনে হচ্ছিলো সেটা চলে যাচ্ছে আরও দ্রুত! “কতো কিছু বলে ফেলেছি”, এটার চাইতেও তেতো সত্য ছিলো “কতো কিছুই বলা বাকি!” অথচ সেই বাকি কথাগুলো আর বলাই হলোনা আমার। আবারও আমরা রিকশায় উঠলাম। সে নেমে গেলো তার গন্তব্যে। আমি হাঁটা ধরলাম আমার গন্তব্যে। তবে আফসোসের বিষয় ছিলো আমি তাকে ঠিকভাবে বিদায় জানাতে পারিনি! এভাবে বিদায় দেয়া যায়না তাকে। একটু সুন্দর করে হাসিমুখে, “আবার এসো” না বললে বিদায় হয়না বলেই জানতাম! সেটা হয়নি। সেই আফসোসটা পোড়াচ্ছিলো।

তবে সেটাও শেষ ছিলোনা! আবারও সৃষ্টিকর্তা চাইলেন আমাদের দেখা হোক, আমি যাতে তাকে বিদায় দিতে পারি। হাসিমুখে পারি। সেও হয়তো চাইলো এমন কিছুই। আবারও প্রার্থনা মিলে গিয়ে তার সাথে আমার দেখা হলো। তবে এবারের বাসা থেকে তার গন্তব্যে যাওয়ার পথটা বিশাল মনে হচ্ছিলো। শরীরটাকে ভারী মনে হচ্ছিলো। তবুও গেলাম। সে যেই গাড়িতে করে যাচ্ছিলো, গাড়িটা হুট করেই আমার চোখের সামনে চলে এলো। আমি তাকাতেই দেখলাম সেও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার চোখের কোণে হয়তো তার বিদায়ের যন্ত্রণায় কয়েক ফোঁটা জলও গিজগিজ করছিলো। জানিনা আমি ঠিক। তবে তার চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো গাড়ির কাঁচটা ভেদ করে সে আমার বুকে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসবে। কিন্তু সেটা হলোনা। মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে থেকে সে আর তাদের গাড়িটা হারিয়ে গেলো। আমি তখনো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ানো। হুস ফিরতেও আমিও আর একটু দেখার লোভে দৌঁড়ে গেলাম গাড়িটার পেছনে। কিন্তু আর দেখতে পেলাম না তাকে। সেও আমাকে পারেনি। তবে গাড়িটা দেখতে পাচ্ছিলাম বেশ কিছুক্ষন। সেই প্রথম দিন, তাকে বিদায় দেয়ার সময় ঠিক যেমন করে তার রিকশার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তেমনটাই হচ্ছিলো ওইদিনও। তাকে দেখতে পাবোনার ধারণাটুকু আবারও কি যে যন্ত্রণা দিচ্ছিলো তখন! এই যন্ত্রণা নিতে না পেরেই বোধহয় যতক্ষন না চোখের আড়াল হচ্ছিলো তার গাড়িটা, আমি তাকিয়েই ছিলাম। আমি তাকিয়েই ছিলাম, অপলক দৃষ্টিতে! চোখের কোণে থাকা চিকচিক করতে থাকা জলগুলো নিয়ে হেঁটে ফিরছিলাম বাসার দিকে। আবারও আমার শরীর ভার হয়ে যেতে শুরু করলো।

আমি আসলেও জানতাম, একটু সুন্দর করে হাসিমুখে, “আবার এসো” না বললে বিদায় হয়না! তবে সেদিন হয়েছিলো। শুধুমাত্র তার দুই চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে বিদায় দিয়েছিলাম সেদিন আমি, নয়তো বিদায় না দিতে পারার আফসোসটা আসলেও থেকে যেতো। আর হয়নি সেই আফসোস।

আমি সেদিন থেকে মানি, কথা ছাড়াও বিদায় দেয়া যায়! শব্দ ছাড়াও বিদায় দেয়া যায়! তবে এতোটুকুও জেনে গিয়েছিলাম সেদিন, শব্দ ছাড়া যেই বিদায়টুকু হয়, সেই বিদায় বিষাদের হয়, যন্ত্রণার হয়, কষ্টের হয়। আর তাই হয়তো, সেদিনের পর থেকে শুধু আর একটাবার দুজন দুজনকে দেখার জন্য ছটফট করে চলেছি আমরা! ভীষণভাবে!!!

শেয়ার করুনFacebookTwitterWhatsApp
লিখেছেন
সিয়াম মেহরাফ
আলোচনায় যোগ দিন

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ একজন লেখক এবং গল্পকথক। তার বর্তমান মৌলিক বইয়ের সংখ্যা দুইটি। লেখালিখির পাশাপাশি অভিনয়ও তার আরেকটি প্যাশন।

নোটঃ

এই ওয়েবসাইটটির সকল ছবি, লেখা এবং ভিডিও সিয়াম মেহরাফ দ্বারা সংরক্ষিত। ওয়েবসাইটটির কোনো তথ্য ক্রেডিট কিংবা কার্টেসি ছাড়া কপি না করার অনুরোধ রইলো।

error: