বেঁচে থাকার গুজব – জুবায়ের ইবনে কামাল

বেঁচে থাকার গুজব – জুবায়ের ইবনে কামাল

বেঁচে থাকার গুজব - জুবায়ের ইবনে কামাল

কিছু কিছু অপরাধের সূত্র খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা। হতেও পারে সেটা দশ বছর পুরোনো কিছুর সাথে পুরোপুরি জড়িত! বাস্তবতার এই নিষ্ঠুরতা টের পাওয়া বড় দায়। আমরা বুঝে উঠতে পারিনা কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে। কারণ, সেই গল্পটা আমাদের এখনও অজানা।

‘বেঁচে থাকার গুজব’ জুবায়ের ইবনে কামাল-এর প্রথম বই। ফেসবুকে তার লেখালিখির ভক্ত অনেক আগে থেকে থাকলেও, বইতে তিনি তার সেই ভক্তকে নিরাশ করেছেন কিনা সেটা নিয়েই আলোচনা করবো আমি আজ।

পাঠ প্রতিক্রিয়া : রাস্তার মাঝখানে হুট করেই হয়ে গেলো দুটো খুন। সেটাও সবার সামনে। খুন হওয়া মানুষগুলোর সাথে এতো কিসের ক্ষোভ খুনির? নাকি অন্য কারো ক্ষোভের আগুন নেভাতেই কেউ নেমেছে মাঝরাস্তায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার পাশাপাশি আরো কিছু প্যাঁচিয়ে যাওয়া রহস্যের উত্তর দিতেই এই ১৪৪ পৃষ্ঠার বই বেঁচে থাকার গুজব!

প্রথমত, গল্পটা লেখার ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা অবলম্বন করেছেন লেখক। সেই ভিন্নতা যদিও একটা ছিলোনা। ‘পার্সপেক্টিভ’ জিনিসটা লেখক বিভিন্ন কোণ থেকে দেখিয়েছেন। এই মুহূর্তে যেটা আপনি আপনার চোখের সামনে দেখছেন, সেই একই ঘটনা আপনার অপর পাশের মানুষটা কিভাবে দেখছে কিংবা যার দ্বারা হচ্ছে সে কিভাবে দেখছে এভাবে গল্পটা বলে গিয়েছেন লেখক। এক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে কয়েকটি। একই গল্পে কে কিভাবে ভাবছে সেটা বুঝতে পারা যাচ্ছিলো খুব স্পষ্টভাবেই। এছাড়াও সবার পক্ষ থেকেই একটা জাস্টিফিকেশন ছিলো, যেখানে সবাই তারা ঠিক। এই পার্সপেক্টিভ বিষয়টায় দারুন খেলা দেখিয়েছেন লেখক। মনে করুন আপনি রিকশায় ছড়ে কোথাও যাচ্ছেন, এই সময়ে আপনি কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছেন, আর রিকশাওয়ালা মামা রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার অনুভূতিটা ঠিক তখন কেমন হবে? আর ওই একই সময়ে রিকশাওয়ালা মামার অনুভূতিটা কেমন হবে? দুটোই কোনো না কোনোভাবে আলাদা হবে তাইনা? সুতরাং, এরকম কিছু যদি দুইদিক থেকে দেখার সুযোগ হয়, তবে সেটা সত্যিই দারুন বিষয়। আমি সেক্ষেত্রে ফিল করতে পেরেছি, নিরপরাধ আর অপরাধী দুই পক্ষের মানুষেরই চাহিদা, ইচ্ছা কিংবা বলা যেতে পারে ‘পার্সপেক্টিভ’

ভিন্নতার দ্বিতীয় ধাপে, প্রতিটা অধ্যায় শেষেই লেখক বিখ্যাত কিছু কবিদের কবিতার লাইন, কুরআনের আয়াত, বাইবেলের লাইন ইত্যাদি রেখেছেন। এটাকে ট্রিবিউট বললেও ভুল হবেনা। যাদেরকে আপনি ছোটবেলা থেকে চেনেন তাদেরকে আপনি একটা বইয়ের ভেতরেই পড়তে পারছেন, কিংবা যা আপনি বিশ্বাস করেন সেসবও পড়তে পারছেন, এটা সত্যিই দারুন মুগ্ধতার একটা বিষয়। তবে এক্ষেত্রে কবিতার লাইন কিংবা আয়াত বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন লেখক।

দ্বিতীয়ত, ধরুন লেখক আপনাকে বলে দিয়েছেন আগেই যে খুনি খুনটা কিভাবে করেছে। এরপরে গোয়েন্দারা এলেন এবং খুঁজে যাচ্ছেন কি হয়েছে আসলে এখানে। তবে আপনি শুরু থেকেই বিষয়টা জানেন। গোয়েন্দারা যেখানে হিমসিম খাচ্ছে খুনের প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে, সেখানে ইতোমধ্যে আপনাকে বলে দেয়া হয়েছে সমস্ত কিছুই। এই জেনে যাওয়া বিষয়টা পাঠক হিসেবে আমাকে দারুন অনুভূতি দিয়েছে। ‘আরেহ! আমি তো জানিই কিভাবে হয়েছে!’ এই অনুভূতিটা ভাষায় অপ্রকাশযোগ্য। তবে প্যাটার্ন আগেই বলে দেয়ার বিষয়টা অনেকটা রিক্সি হয়ে যায়। কারণ, পাঠক তখন গল্পটা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে কিংবা বোরিং ফিল করতে শুরু করে। তবে সেক্ষেত্রেও উতরে গিয়েছেন লেখক। সবকিছু বলে দেয়ার পরেও মোটিভের অপেক্ষায় আটকে রেখেছেন পাঠককে।

তৃতীয়ত, ‘এই ভালো এই খারাপ, ওওওও’ ভাববেন না তৃতীয়ত বলে এটা কেনো লিখলাম। এই গানটা আপনারা শুনেছেন কিনা জানিনা, তবে এই গানটার এই একই লাইনটাই লেখক যেভাবে তার লেখায় টেনে এনেছে সেটা আমাকে হাসতে রীতিমতো বাধ্য করেছে বলা যায়। পুরো লেখার ভেতরে এরকম কয়েকটা জিনিস আছে যেগুলো পড়ে খুবই হাসি পাচ্ছিলো। সেক্ষেত্রে লেখকের চেষ্টা এক্ষেত্রেও সফল। তিনি হাসাতে পেরেছেন, এরকম সিরিয়াস একটা গল্প বলতে গিয়েও।

গল্পটার প্লট নিয়ে যদি বলতে হয়, তবে ফ্ল্যাপে যতোটা সাবলীলভাবে লেখাটা ততটা মোটেও নয়। লেখকের গল্পের ডিজাইন ছিলো অন্যরকম। তিনি পুরো বই জুড়ে পাঠককে ধরে রাখতে খুব দারুনভাবে সক্ষম হয়েছে। অধ্যায় শেষে, কবিতার লাইনের আগে রেখে গিয়েছেন কিছু দারুন লাইনও। যেগুলো আপনার মাথা ঘুরিয়ে দেবে, আপনার মোটেও তখন ইচ্ছে করবেনা বইটাকে হাত থেকে রেখে অন্য কিছু করতে। দুটো খুনের সম্পর্ক কি? কেনো হয়েছে এটা? এই খুনগুলোর সাথে পুরোনো কোনো একটা রহস্যের সংযোগটাই কিংবা কোথায়? এতোগুলো প্রশ্ন তৈরি করেছেন লেখক খুব দ্রুতই। যেখানে ফ্ল্যাপ পড়ে আমি জাস্ট দুটো খুনের হত্যার কারণ জানতে লেখকের সাথে ছিলাম, সেখানে লেখক হাজারও অজানা প্রশ্ন তুলে এনে পুরো থমকে দিলেন আমাকে। যেনো তিনি পৃথিবীর গল্প শোনানে এনে, কল্পনায় ঘোরাচ্ছেন পুরো সৌরজগত। এক্ষেত্রেও লেখক প্রশংসার দাবিদার। একটা গল্পকে অনেকগুলো এঙ্গেল থেকে দেখা যায়, সেটা বুঝিয়ে দিলেন লেখক।

চরিত্রগুলোর ভেতরে খুব ক্ষমতাবান মানুষজন থাকলেও, তাদেরকে স্বাভাবিক আর সাধারণ রেখেছেন পাঠকের স্বার্থে। সব গোয়েন্দা অফিসারই যে সবসময় কফিই খাবেন, বাস্তবে কিন্তু এমনটা হয়না। হতেও পারে তিনি অন্য কিছু খাচ্ছেন স্বাভাবিক মানুষের মতো। আবার এও হতে পারে তিনি পেঁপে খাচ্ছেন সাধারণ মানুষগুলোর মতো, তাইনা? এভাবেই রেখে গিয়েছেন তিনি চরিত্রগুলোকে বইয়ের প্রতিটা পাতায়। তাদের তদন্তের ধাপগুলোকে খুবই সাবলীলভাবেও দেখিয়েছেন একইসাথে। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় লেখক এটাই চেয়েছিলেন, যে তার সবগুলো চরিত্রই হিউম্যান বিইং আকারে থাকুক। সেক্ষেত্রেও তিনি সফল হয়েছে শতভাগ।

গল্প শেষ। খুনি ধরা পড়েছে। জবানবন্দি দিয়েছে। এরপরেও ছিলো কিছু বাড়তি পৃষ্ঠা। কে জানে, কি করতে চাচ্ছেন লেখক এই বাড়তি পৃষ্ঠাগুলোতে! এই ভেবেই যখন পড়া শুরু করলাম, দেখা গেলো রোলার কোস্টার রাইড রেখে গিয়েছেন তিনি শেষ কয়েকটা পাতাতেও। শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছু জানতে পেরে গিয়েছি, ভাবতে না ভাবতেই মুহুর্তের মধ্যে লেখক শুরু করে দিয়েছিলেন তার শেষ চাল। পুরোপুরিই রোলার কোস্টার রাইড ছিলো শেষের অংশটুকু। যেখানে তিনি রেখে গিয়েছেন প্রশ্ন। বিশাল বড় প্রশ্ন। আমার সেই প্রশ্নটা দেখে মনে হয়েছিলো, ‘এই গল্প আমার এখনও অজানা’

সর্বোপরি, দারুন একটা সময় কেটেছে জুবায়ের ইবনে কামাল-এর প্রথম বই ‘বেঁচে থাকার গুজব’ এর সাথে। এবং তিনি আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। তার লেখার হাতের প্রতি থাকা বিশ্বাসের জন্যেই অনেকদিন থেকে অপেক্ষা করছিলাম এই বইয়ের। অধ্যায় শেষে কবিতা রেখে যাওয়ার মতো করেই তিনি, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার লেখনীর গুনে তিনি আটকে রেখেছেন আমাকে তার গল্প জুড়ে। শুরুর দিকের অধ্যায়গুলোতে খুবই সফট টোনেও বলে গিয়েছেন কিছু গল্প। সেই সফট টোন যেমন মুগ্ধ করেছে, মুগ্ধ করেছে ক্রাইমের ক্ষেত্রে তার সাবলীলভাবে ব্যবহার করা ‘থ্রিল’ টোন। সবমিলিয়ে পড়া শেষ করে মনেই হয়নি এটা তার প্রথম বই। এই যাত্রায়ও তিনি আবার নিজেকে প্রমাণ করলেন। লেখকের জন্য মন থেকে শুভকামনা। তিনি সামনের দিনগুলোতে যেনো আরও নানা গল্পে তার লেখনশৈলীর জাদুতে বুদ করে রাখতে পারেন পাঠক হৃদয়। সেটাই কাম্য।

‘তুমি যা ভাবছো, তা যদি দেখতে না পাও ভেবোনা আমি মনে মনে রেখেছি সে গল্প, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তুমি সে গল্পেই বুধ হয়ে রও কিছু উত্তর দেবোই, যা পুরোটা না হলেও অল্প!’ -সিয়াম মেহরাফ

বইঃ বেঁচে থাকার গুজব
লেখকঃ জুবায়ের ইবনে কামাল
প্রকাশনীঃ বাতিঘর
পৃষ্ঠাঃ ১৪৪
মুদ্রিত মূল্যঃ ২২০

শেয়ার করুনFacebookTwitterWhatsApp
লিখেছেন
সিয়াম মেহরাফ
আলোচনায় যোগ দিন

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ একজন লেখক এবং গল্পকথক। তার বর্তমান মৌলিক বইয়ের সংখ্যা দুইটি। লেখালিখির পাশাপাশি অভিনয়ও তার আরেকটি প্যাশন।

নোটঃ

এই ওয়েবসাইটটির সকল ছবি, লেখা এবং ভিডিও সিয়াম মেহরাফ দ্বারা সংরক্ষিত। ওয়েবসাইটটির কোনো তথ্য ক্রেডিট কিংবা কার্টেসি ছাড়া কপি না করার অনুরোধ রইলো।

error: