জলতরঙ্গ – হাসান ইনাম

জলতরঙ্গ – হাসান ইনাম

জলতরঙ্গ - হাসান ইনাম

মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত। কিছু ঘটে যাওয়া জিনিস সেই অদ্ভুত জীবনটাকে বানিয়ে দেয় আরও রহস্যময়। সেই উত্তর সারাজীবন বসে খুঁজে বেরিয়ে যায় মানুষ। মাঝে মাঝে উত্তরটা পেয়ে যায়, মাঝে মাঝে পাওয়া হয়না। তবে সবসময়ই উত্তর পেয়ে গেলেই যে সবকিছু শেষ বিষয়টা তেমনও নয়। ঘোলাটে রয়ে যায় অনেককিছুই। এই সবকিছু মিলিয়েই জীবনের যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, কিংবা চলতে থাকে সেটাই জলতরঙ্গ।

পাঠ প্রতিক্রিয়া: লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘ঢাকায় ফাগুন’ হলেও, আমি জলতরঙ্গ দিয়েই শুরু করেছিলাম তার গল্প পড়ার যাত্রা। এই যাত্রায় সামিল হতে গিয়ে বাগিয়ে নিয়েছিলাম অটোগ্রাফকৃত প্রথম বইটিই। যাত্রার শুরুতেই চলছিলো কিছু গুচ্ছ গুচ্ছ ঘটনা। এখন এখানে, তো পরে অন্য কোথাও। এভাবে চলছিলো প্রথম দিকের যাত্রা। গল্প পড়তে পড়তে কখনো ঘুরে এসেছি কুয়েত, কখনো বা উপসাগরে, কখনো ঢাকার চিরচেনা জায়গাগুলোতে। গুচ্ছ গুচ্ছ কয়েকটা ঘটনাকে সামনে এনে, অধ্যায় জুড়ে তিনি তৈরি করেছেন গল্পের ক্যানভাস। যেখানে এনেছেন বহু চরিত্র। ক্যানভাস তৈরি করতে না করতেই, চরিত্রগুলোতে তিনি ছেড়েছেন চোখের সামনে। সেখানেই তারা তাদের জীবন অতিবাহিত করছে, আর মনে হচ্ছিলো সেগুলো আমি দেখেছি নিজ চোখেই!

গল্পটা বিশাল বড় ক্যানভাসের। যেটা লেখনীর গুনে অসাধারণভাবে সামলে গিয়েছেন লেখক। লুপোহোল নামক শব্দটা নেই এই গল্পে। এতো বড় গল্প এভাবে সামলানোটা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। যদিও কিছুক্ষন আগে বলেছি, গল্পটা বিশাল ক্যানভাসের, তবুও যদি গল্পটা সম্পর্কে কিছু কথা বলতেই হয়, সে হিসেবে গল্পটা জীবনের, কিছু মানুষের, বন্ধুত্বের, আর এসবের পেছনে ঠকঠক করে দরজায় কড়া নেড়ে যাওয়া রাজনীতির। বন্ধুর জন্য বন্ধুর যে টান সেটা দেখা গিয়েছে এই গল্পে। এবং সেটা করতে গিয়ে মোটেও কোনো নাটকীয়তার আশ্রয় নেননি লেখক। যদি বলতে হয়, পুরোটাই একদম নিখুঁতভাবে লেখা। এছাড়াও রয়েছে রাজনীতির ভয়াবহ চাল, যেই চাল বুঝে ওঠা আপনার আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটাও ন্যাচারালিই দেখিয়েছেন লেখক।

ক্যানভাসের ব্যাপারটা বলতে গেলে এক্ষেত্রে সবচেয়ে দারুন বিষয় এতো বিশাল প্লট নিয়ে কাজ করা। যেটার জন্য লেখক সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। এতো এতো কিছু টেনে এনেছেন গল্পে, সেগুলোর কোনোকিছুই অসংগতিপূর্ণ নয়। সবকিছুই এসেছে গল্পের প্রয়োজনে। আবার ছুটেও যায়নি হাত থেকে কিছুই। সবগুলোকেই একটা দারুন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক। এতোগুলো চরিত্রকে গল্পে এনে দাঁড় করানো, একই সাথে তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় ছেড়ে দেয়া সবকিছুই ভালো লেগেছে লেখকের লেখনীর গুনে।

লেখনী সম্পর্কে বলতে গেলে, লেখক খুবই ভালো গল্প বলতে পারেন। প্রতিটা অধ্যায়ের শেষের লাইনগুলো গতানুগতিক লেখার মতো নয়। লেখক পুরোপুরিই আলাদা একটা ধাঁচের ফিনিশিং লাইন দিয়ে অধ্যায় শেষ করেছে। প্রায় অধ্যায়গুলোতেই সেটা পরিলক্ষিত। আপনার পাঠক হিসেবে কি জানার থাকতে পারে, সেটাও আপনার হয়েই বলে গিয়েছেন লেখক। এটা করতে গিয়ে হেয় করেননি পাঠকদেরকে। বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রতি পদে, যে তিনি যা বলতে যাচ্ছেন সেটার সাথে পাঠকের সম্পৃক্ততা রয়েছে কিংবা পাঠক সেটা ইতোমধ্যে জানেন। এসবের বিচারে লেখার ধরণ দারুন ছিলো পুরো গল্প জুড়েই। এমন কিছুই আসেনি যা পড়ার পথে বাধাগ্রস্ত করতে পারে পাঠক হৃদয়কে।

চরিত্র সম্পর্কে আসি এবার। চরিত্রগুলোকে যথেষ্ট পরিমাণে মানবিক রাখা হয়েছে। সবাই খুবই সাধারণ মানুষ। যারা আমাদের মতোই। হাসে, কাঁদে, আবার কষ্ট পেলেও হাসিমুখে কথা বলে যেতে পারে। আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকেই দেখাতে চেয়েছেন লেখক গল্পে। এমন কেউই নেই যার সাথে নিজেকে রিলেট করতে গেলে ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য হবে। চরিত্রগুলোকে ডেভেলপ করতে ভালো সময় দিয়েছেন লেখক। অযথা কিছু না বলেই, চরিত্রগুলোকে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার বিষয়টা ভালো লেগেছে অনেক। মনে হয়েছে, লেখার সময় লেখক তাদের জীবনটা অনুভব করতে পারছে! আবার, এটাও বলে যেতে পারে লেখক তাদেরকে খুব ভালো করে চেনে। এখানেই লেখকের স্বার্থকতা। একটা গল্প লিখতে গিয়ে তার টেনে আনা চরিত্রগুলোকে এমনভাবে তিনি তুলে ধরছেন, যেনো তাদের সবাইকে লেখক চেনেন, বিষয়টা দারুন। কিছু কিছু সময় তিনি দরদ হীন ভাবে চরিত্রগুলোর প্রতি নির্দয় হয়েছেন, সহমর্মিতা দেখাননি। সব মিলিয়ে এক্ষেত্রেও লেখক দারুন কাজ দেখিয়েছেন।

টুইস্ট রয়েছে গল্পটাতে। তবে অবশ্যই একটা নয়। পলিটিকাল থ্রিলার, তার উপর এতো বিশাল ক্যানভাস, এতোগুলো চরিত্র, এসব কি শুধু শুধুই? মোটেও না। কয়েকটা ধাপে রয়েছে সেই টুইস্ট। কিছু টুইস্ট আপনি চার ভাগের তিন ভাগ গল্প পড়ার আগেই আপনাকে বলে দেয়া হবে। আপনি তখনও ভাবতে পারবেন না, এই গল্পে পড়ার আর কিছু নেই, টুইস্ট জেনে গিয়েছি, আর পড়বোনা ইত্যাদি। বিশাল ক্যানভাস জুড়ে তিনি এই জিনিসটাই ধরে রেখেছেন। শেষ দিকে গিয়ে একটা টুইস্ট দিলেও, আপনার মনে হতে থাকবে, ওই নির্দিষ্ট বিষয়টা সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না। কিংবা গত অধ্যায়ের শেষে বলা কথাটার কোনো জাস্টিফিকেশন নেই আপনার কাছে। তখন আপনি আবারও সামনে আগাতে বাধ্য হবেন, আবারও পৃষ্ঠা উল্টাবেন। যখন কোনো লেখক তার গল্প দিয়ে পাঠককে এভাবে ধরে রাখতে পারে তখন সেই লেখকের লেখাটা স্বার্থকতা পায়। সেখানেও লেখক বরাবরের মতোই সফল। শেষ টুইস্ট গুলো ছিলো অসাধারণ। মূল জিনিসগুলো জানার পরে, আপনি সবকিছু রিলেট করতে পারবেন। কেনো বলা হয়েছে এতো গল্প, কেনো দেয়া হয়েছে এতো জায়গার বিবরণ, কেনো রয়ে গেছে এতো চরিত্র বিভিন্ন জায়গায়! একদম শেষের টুইস্টটা আপনাকে ভাবাতে বাধ্য করবে বহুবার, শতবার। মনে হতে থাকবে, পুরো গল্প জুড়ে তাহলে কি শুধুই আপনি ভুল ভেবে গেলেন? তাহলে কি যা হচ্ছিলো সবকিছু অন্য কারণেই হচ্ছিলো? এভাবেই আপনাকে শেষের দিকে ভাবাবেন লেখক। এটাই ছিলো গল্পের শেষ মাস্টারস্ট্রোক!

ফিনিশিং দারুন ছিলো এই গল্পের। এতো বড় ক্যানভাস যাতে আপনি শেষে গিয়ে খেই হারিয়ে না ফেলেন, তার জন্য লেখক করেছেন দারুন ব্যবস্থা। শেষের দিকে, সব তথ্যগুলো সাজানো আছে আপনার সুবিদার্থে। তবে ভুলেও ভাববেন না, এসব গল্পের বাইরে। এই সাজানো দিকগুলোও গল্পের ভেতরেই দারুনভাবে ইমপ্লিমেন্ট করেছেন লেখক। পুরোটাই গল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যাখা। বই শেষ করার পরে পড়ছেন, বা সেভাবে লেখা হয়েছে বিষয়টা এমন নয়। লেখক যে এই বিষয়টা মাথায় রেখেছেন পাঠকের জন্য, সেটার জন্য তিনি প্রশংসার দাবীদার। সবগুলো পয়েন্ট আকারে বলে গিয়েছেন এবং আপনি তখনই বুঝতে পারবেন, শুরুর দিকে কোন ব্যাখাটা কিংবা কোন কাজটা কিংবা কোন জায়গাটা কেনো এনেছিলেন তিনি গল্পে।

সর্বোপরি, জলতরঙ্গ দারুন একটি উপভোগ্য উপন্যাস। যেটার গল্প, চরিত্র, ফিনিশিং, এন্ডিং আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। আর এই মুগ্ধ হওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকেই এতোক্ষনে বলে গেলাম জলতরঙ্গ সম্পর্কে আমার মতামত। আশা করি, আপনাদেরও এই উপন্যাসটি ভালো লাগবে। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মোটেও নিজের ভাবনাগুলোকে সত্যি ভাবতে যাবেন না, লেখক তাহলে আপনার ভাবনাগুলোকে ধোঁকা দিতে তৈরিই আছে জেনে রাখবেন। জলতরঙ্গের সাথে আপনার যাত্রা নিরাপদ হোক!

বইঃ জলতরঙ্গ
লেখকঃ হাসান ইনাম
প্রকাশনীঃ বাতিঘর
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩২০
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫২০

শেয়ার করুনFacebookTwitterWhatsApp
লিখেছেন
সিয়াম মেহরাফ
আলোচনায় যোগ দিন

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ

সিয়াম মেহরাফ একজন লেখক এবং গল্পকথক। তার বর্তমান মৌলিক বইয়ের সংখ্যা দুইটি। লেখালিখির পাশাপাশি অভিনয়ও তার আরেকটি প্যাশন।

নোটঃ

এই ওয়েবসাইটটির সকল ছবি, লেখা এবং ভিডিও সিয়াম মেহরাফ দ্বারা সংরক্ষিত। ওয়েবসাইটটির কোনো তথ্য ক্রেডিট কিংবা কার্টেসি ছাড়া কপি না করার অনুরোধ রইলো।

error: